
আলভী হোছাইন সিফাত, স্টাফ রিপোর্টার :
কক্সবাজারের অপার সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় ধুঁকছে দেশের পর্যটনশিল্প। কক্সবাজারের পর্যটনখাতকে এখনই ঢেলে সাজানোর উপযুক্ত সময় বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ।
অপার সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও কক্সবাজার বিশ্বের নামকরা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নিতে পারেনি। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতকে কাজে লাগাতে পারেনি কোনো সরকার। বারবার বিভিন্ন পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনার কথা বলা হলেও তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। অথচ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের অর্থনীতির চাকা নতুন শিখরে নেওয়া যেত।
কক্সবাজারের উন্নয়নে ২০১৬ সালে গঠিত হয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক)। এতে করে অবস্থা হয়েছে আরও হ-য-ব-র-ল। সমন্বয়হীনতার কারণে বারবার উন্নয়ন ও গৃহীত পদক্ষেপগুলো ব্যাহত হয়েছে।
গত কয়েকদিন পর্যটন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিগত সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের ভিসা এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। ফলে অসংখ্য দেশি পর্যটক ভারতে না যেতে পেরে মালদ্বীপ, নেপাল, সিঙ্গাপুরমুখী হয়ে পড়েছেন। এদের কক্সবাজারমুখী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হলে কক্সবাজারই হবে এশিয়ার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। শুধু দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর সোনাদিয়াকে কেন্দ্র করে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করা গেলে দেশীয় উচ্চবিত্ত পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদেরও কক্সবাজারমুখী করা সম্ভব।
একসময় কক্সবাজার স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে বিখ্যাত ছিল। কক্সবাজারে বিশ্বমানের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করে ‘মেডিকেল ট্যুরিজম’কে প্রমোট করলে শুধু কক্সবাজার নয়, দেশের স্বাস্থ্যখাত ও পর্যটনখাত অনেকদূর এগিয়ে যাবে। পর্যটকদের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে আনতে হবে নতুনত্ব।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বীপ মহেশখালীর সঙ্গেও ‘কেবল কার’ চালু করা জরুরি। এছাড়া এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন, বিদেশি পর্যটকদের জন্য আলাদা জোন, পর্যটকদের নিরাপত্তায় সি নেটিং সিস্টেম, ওয়াচ টাওয়ার, নিরাপদ প্যারা সেইলিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।
দিনভর সৈকত ও অন্যান্য স্থানে ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যায় বা রাতে পর্যটকদের সময় কাটানোর মতো তেমন পরিবেশ নেই। এসব বিষয় আমলে নিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে, কক্সবাজার শহরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নাইট লাইফের জন্য আন্তর্জাতিক মানের শপিং মল ও সিনেপ্লেক্স গড়ে তোলা জরুরি।
কক্সবাজার সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, পর্যটকরা শুধু সমুদ্রসৈকত ও হোটেলে ঘুমানোর জন্য আসেন না। তাদের বিনোদনের জন্য বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এতে করে পর্যটনখাতে আয়ও বাড়বে।
সূত্র বলছে, ভ্রমণ ও পর্যটন সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপে দেখা গেছে, এই সূচকে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। এ ছাড়া এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শেষে।
পর্যটকদের ‘নাইট লাইফ’ নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, সি-বিচ ও হোটেলে রাত্রিযাপনের মধ্যেই পর্যটনকে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। এ জন্য উন্নতমানের শপিং মল, সিনেপ্লেক্স, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক চালু করা উচিত। একই সঙ্গে বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে সব ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন দরকার।
বিদেশি পর্যটক বাড়ানোর জন্য তাদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যটনখাতে বিনিয়োগ ও সুযোগ সুবিধা বাড়ানো দরকার জানিয়ে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত থাকার পরও আমাদের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান সামান্য। যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নগণ্য। শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপালে আসা পশ্চিমা বিশ্বের পর্যটকরা বাংলাদেশে আসেন না—— এটা হতাশাজনক। প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করে পর্যটকবান্ধব পরিকল্পনা করতে হবে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে দিন দিন বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা নিম্নগামী। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুলসংখ্যক বিদেশি কর্মী কাজ করছেন। এর ফলে বিদেশি আগমনের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। সেই তুলনায় পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে বিদেশি পর্যটক আগমনের সুনির্দিষ্ট তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি, বিদেশি পর্যটক এখন আসছেন না বললেই চলে।
এসবি থেকে পাওয়া বিদেশি নাগরিক আগমনের তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে দেশে আসেন পাঁচ লাখ ৬৬৫ জন বিদেশি নাগরিক। এর পরের দুই বছরে আসেন যথাক্রমে পাঁচ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ ও ছয় লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে এই সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় এক লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জনে। পরের বছর আরও কমে এক লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ ও ২০২৩ সালে দেশে আসা বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার ২৬৮ ও ছয় লাখ ৫৫ হাজার ৪৫১।
বর্তমানে শুধু বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজারমুখী হচ্ছে না তা নয়। দেশীয় ভ্রমণপিপাসুরা ছুটছেন মাত্রাতিরিক্ত হারে বিদেশে। এ যাত্রায় সবার ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে গমন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাইল্যান্ড।
পর্যটন ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশীয় পর্যটন অঞ্চলে হোটেল মোটেলে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া, নিরাপত্তা ঘাটতি, যাতায়াতে বাড়তি খরচ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন অনেকে। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাড়তি সুযোগ-সুবিধা না থাকা, ব্র্যান্ডিংয়ে ঘাটতি ও পরিকল্পিত পর্যটন ব্যবস্থার অভাবে পর্যটক সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
পর্যটকরা বলছেন, বাংলাদেশের তুলনায় বিদেশে ভ্রমণ সাশ্রয়ী। ফ্রেশ পাসপোর্টে কোনো ডকুমেন্ট ছাড়াই মাত্র ৭৫ হাজার টাকায় ছয় রাত সাত দিনের শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ ট্যুর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এই ট্যুরের আওতায় রিটার্নের এয়ার টিকিট, চারতারকা হোটেল, সঙ্গে ব্রেকফাস্ট, পিক অ্যান্ড ড্রপ, সিটি ট্যুর, অল ট্যাক্স ও ট্যুর গাইড পাওয়া যাচ্ছে। ট্যুরের বিভিন্ন প্যাকেজ পাওয়া যায় বিভিন্ন ট্যুর এজেন্সিতে। যা কক্সবাজারের তুলনায় কম।
কক্সবাজারকে আধুনিক ও পরিকল্পিত পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ১৭৪ কোটি ৭২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপনগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল বলেন, আগামী জুলাইয়ের মধ্যে মহাপরিকল্পনা প্রণীত হবে। এরপর এখানকার পর্যটন শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।